ডায়বেটিস কি ? ডায়বেটিস কেন হয় ? ডায়বেটিস এর লক্ষণ ?ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখার উপায় ?
- ডায়বেটিস কি ?
ডায়াবেটিস হল শরীরের এমন একটি গুরুতর অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন দক্ষতার সঙ্গে (কার্যকরভাবে) ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। ইনসুলিন মানুষের শরীরের কোষগুলি তে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করে।
- ডায়বেটিস কেন হয় ?
ডায়াবেটিস একধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। শরীরে ইনসুলিন আছে, কিন্তু কাজ করতে পারছে না। কিংবা ইনসুলিন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সাধারণত চার ধরনের ডায়াবেটিসের কথা বলি। টাইপ-১, টাইপ-২, জেস্টেশনাল এবং অন্যান্য। টাইপ-১ মানে হলো, যেভাবেই হোক, যাঁদের শরীরে ইনসুলিন নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁদের যদি আলাদা করে ইনসুলিন দেওয়া না হয়, তাহলে তাঁরা মারা যেতে পারেন। আমরা যখন বাইরের নানা ধরনের খাবার খাই, ফাস্ট ফুড খাই, তখন শরীরে একধরনের পরিবর্তন আসে। দেখা যায়, শরীরে ইনসুলিন আছে, কিন্তু সেটা কাজ করতে পারছে না। তখন আমরা যে খাবারই খাই, সেটার গ্লুকোজ জমে যায়। এটা টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
- ডায়বেটিস এর লক্ষণ ?
- ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা
- দুর্বল লাগা’ ঘোর ঘোর ভাব আসা
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
- সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা কমে হাইপো হওয়া
- মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া
- কোন কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া
- শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা
- চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব
- বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা
- চোখে কম দেখতে শুরু করা
- ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখার উপায় ?
১. প্রতি বেলার খাবার খেতে হবে সময়মতো।
২. কী পরিমাণ খাওয়া হচ্ছে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি খাবার বেশি পরিমাণে না খেয়ে অল্প অল্প পরিমাণেও তো খাওয়া যায়। চিকিৎসক বললেন, ভাত না খেয়ে রুটি খেতে। এখন ভারী ভারী ছয়টা রুটি খেলে তো আর কাজ হলো না। বরং উল্টো ফল হবে।
৩. আঁশযুক্ত গোটা শস্য খাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে।। ময়দার রুটি আর মিলে ছাঁটা চালের বদলে লাল আটার রুটি বা ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খেলে ভালো। গোল আলু, যতটা পারা যায় কম খেতে হবে। আলু খেতে হলে অবশ্যই তা ভাত বা রুটি ইত্যাদির পরিবর্তে হবে, সবজি বা শাকের বিকল্প হিসেবে নয়।
৪. অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করুন। প্রতিদিন কিছু পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল খান।
৫. ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় পরিহার করুন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করুন।
৬. বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বর্জনীয়।
৭. নিয়মিত শরীরকে সচল রাখতে হবে। হাঁটা উত্তম উদাহরণ হতে পারে।
৮. একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কম্পিউটার ব্যবহার ও কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পায়চারি করুন ও গেম খেলা কমিয়ে দিন। টিভি দেখতে দেখতে চিপস খাবেন না। বেশি ক্ষুধার্ত হলে শসা খান।
৯. ধূমপান বর্জন করুন।
১০. রক্তের গ্লুকোজ, লিপিড, রক্তচাপ ও ওজন অবশ্যই লক্ষ্যমাত্রায় রাখতে হবে। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন। ডায়াবেটিসের রোগীরা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) কাছে চিকিৎসা নিন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্য গ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন–সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত উপদেশ (যা শুধু আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
মনে রাখা ভালো, ডায়াবেটিস চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই বাঞ্ছনীয়।
- ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়!
চর্বিযুক্ত মাছ
চর্বিযুক্ত মাছের তালিকায় রয়েছে স্যালমন, সার্ডিন, হেরিং ইত্যাদি মাছ। যে সব মাছ ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড পূর্ণ, যে সব মাছ ডিএইচএ এবং ইপিএ-এর বড় উৎস সে সব মাছই পারে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এছাড়াও নিয়মিত এই সব মাছ খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কিন্তু কমে যায় অনেকটাই। এছাড়াও এই সব খাবারে থাকে ওমেগা-৩ব ফ্যাটি অ্যাসিড। যা আমাদের শরীরের জন্য কিন্তু খুবই ভাল।
শাকসবজি
নিয়মকরে প্রতিদিন সবজি খাবেন। প্রয়োজনে মাছ-মংসের পরিবর্তে সম পরিমাণ সবজি খান। এতেও কিন্তু শরীর থাকবে সুস্থ আর ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ভিটামিন সি
শাক-সবজি খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন নিয়ম করে ভিটামিন সি আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এতে হার্ট, চোখ সবই কিন্তু ভাল থাকবে।
ডিম
শরীরে রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু ভূমিকা রয়েছে ডিমেরও। আর তাই প্রতিদিন একটা করে ডিম খাবেন। এক্ষেত্রে সিম সিদ্ধ খাওয়াই কিন্তু সবথেকে ভাল। হার্টের রোগীরাও নির্ভয়ে খেতে পারেন ডিম।
ডুমুর
পুষ্টিবিদের মতে, ডায়াবেটিসের রোগীদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে ডুমুর। ডুমুরের মধ্যে ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ রিসার্চ ইন ফার্মেসি অ্যান্ড বায়োসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় অনুযায়ী, ডুমুরে হাইপোগ্লাইসেমিক উপাদান রয়েছে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন যে ডুমুর পাতা ইনসুলিন প্রতিরোধের উন্নতিতেও উপকারী।
মটরশুঁটি
মটরশুঁটির গ্লাইসেমির ইনডেক্স খুবই কম। সেই সঙ্গে পুষ্টিতে ভরপুর। যে কারণে ডায়াবিটিসের রোগীদের জন্য কিন্তু খুব ভাল মটরশুঁটি। এছাড়াও খেতে পারেন ব্রকোলি। এতে কার্বোহাইড্রেট একেবারেই নেই, বরং পুষ্টি আছে অনেক বেশি পরিমাণে। যা বিভিন্ন রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে।
টকদই
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ওজন কমাতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে জুড়ি মেলা ভার টকদইয়ের। নিয়মিত ভাবে খেতে পারলে অনেক রকম উপকার পাবে।
চিয়া সিডস
চিয়া সিডসের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার। যা আমাদের রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়াও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকরী চিয়া সিডস। নিয়মিত খেতে পারলে অনেক রকম উপকার পাবনে।
ফ্ল্যাক্সসিডস
ফ্ল্যাক্সসিডস বা তিসিবীজও কিন্তু শরীরের জন্য বেশ ভাল। নিয়মিত খেতে পারলে সুগার, প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোলেস্টেরলের সমস্যাতেও কিন্তু তা বেশ ভাল কাজ করে। ইনসুলিনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণেও কিন্তু ভূমিকা রয়েছে এই ফ্ল্যাক্সসিডের।
করলা
ডায়াবেটিস কমাতে করলা একটি ভাল ঘরোয়া উপায়। করলা ইনসুলিন-পলিপেপটাইড-পি সমৃদ্ধ, এটি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে। করলাতে ক্যারোটিন এবং মমর্ডিসিন নামক দুটি প্রয়োজনীয় যৌগ থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যৌগিক। ডায়াবেটিস কমাতে সপ্তাহে একবার করলা তরকারি হিসাবে ব্যবহার করুন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই রস একটি ছোট গ্লাস পান করুন। এটির সাহায্যে আপনি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন।
আমের পাতা
আমের পাতা আপনাকে দেহে ডায়াবেটিসের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে। রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সূক্ষ্ম ও কোমল আমের পাতাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসার জন্য তাজা আমের পাতা কার্যকর ঘরোয়া উপায়। আমের পাতায় ভিটামিন সি, এ এবং ট্যানিন থাকে যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক চিকিৎসায় সহায়তা করে। ডায়াবেটিস কমাতে আমের পাতাগুলো ধুয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে এই গুঁড়া পানি দিয়ে পান করুন। এক গ্লাস পানিতে কিছু তাজা আমের পাতা সিদ্ধ করে সারা রাত ঠান্ডা হতে দিন। সকালে খালি পেটে এর পানি পান করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মেথি
মেথি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, গ্লুকোজ সহনশীলতা উন্নত করতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে কারণ এতে ফাইবার বেশি থাকে। মেথি খেলে হজম শক্তি হ্রাস হয়, যাতে রক্তে সুগার সঠিকভাবে শুষে যায়। এটি টাইপ -১ এবং টাইপ -২ ডায়াবেটিস উভয়ই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। ডায়াবেটিস হ্রাস করার ঘরোয়া উপায় হিসাবে ২ চা চামচ মেথি বীজ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি বীজ দিয়ে সেই পানি পান করুন। এ ছাড়া প্রতিদিন মেথি বীজের গুঁড়া গরম বা ঠান্ডা পানি বা দুধের সাথে খান।
ডায়াবেটিস গাছ গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স
‘গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স’ নামের এ ওষধি গাছ ডায়াবেটিস সারাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীনে এন্টি ভাইরাস হিসেবেও এটির ব্যবহার আছে। ‘গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স’ গাছটির বোটানিক্যাল নাম হলেও ইংরেজিতে একে ‘সাবুঙ্গা’ এবং চীনে এটিকে ‘জিয়ান ফেঙ উইই’ বলা হয়। যাদের ডায়াবেটিস, প্রেশার এবং কোলেস্টেরল আছে তারা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২টি পাতা সেবন করলে এসব রোগ থেকে বাঁচা যাবে। তবে যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন এবং গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত তাদেরকে সকালে খালি পেটে ২টি পাতা ও রাতে শোবার আগে ২টি পাতা সেবন করতে হবে।
ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগছেন যারা, এখনই ধূমপান এবং মদ্যপান বর্জন করুন। নিয়মিত সুগারের লেভেল দেখুন। নিয়ম মেনে ওষুধ খান। সারাদিনে অন্তত ঘণ্টাখানেক সময় রাখুন হাঁটার জন্য। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

