পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) কি ? কেন হয় ? কিভাবে পরিত্যান পাওয়া যাই
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম কি
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) হল মহিলাদের মধ্যে অ্যান্ড্রোজেন (পুরুষ হরমোন) এর মাত্রা বেড়ে যাবার জন্য কিছু উপসর্গের সমাহার। পিসিওএস আসলে একটি হরমোনজনিত ব্যাধি। সাধারণত সুস্থ মহিলাদের ডিম্বাশয় প্রত্যেক মাসে একটি করে ডিম্বানু ছেড়ে থাকে।
পিসিওএস একটি হরমোনাল, হেটেরোজিনাস নারী স্বাস্থ্যের অবস্থা; যা বিভিন্নভাবে শরীরের সুস্থতাকে প্রভাবিত করে।
আমাদের দেশে প্রতি ১০ জনে একজন নারী জন্মদানের বয়সে এ অবস্থার মধ্যে পড়তে পারেন।
ওভারি ও পিসিওএস
ওভারি হলো নারীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক সেক্স অরগান; যেখান থেকে নারী হরমোন তৈরি হয় এবং খুব অল্প পরিমাণে পুরুষ হরমোন তৈরি হয়।
নারীর হরমোন মাসিক নিয়ন্ত্রণ করে, ডিম্ব তৈরি করে এবং শরীরের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে।
পিসিওএসে পুরুষ হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায় কিন্তু তা অবশ্যই পুরুষ হরমোনের পরিমাণের চাইতে কম। ইনসুলিন নামে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের সমস্যা হয় যে হরমোন শরীরের কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ইনসুলিন ও এনড্রোজেন বেড়ে যাওয়ার জন্য যে সমস্যাগুলো হয়…
১.অনিয়মিতভাবে মাসিক হওয়া/মাসিক বন্ধ থাকা
২.মানসিক সমস্যা
৩.শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অবাঞ্ছিত লোম গজানো
৪.চুল পড়ে যাওয়া
৫.মুখে ব্রণ বের হওয়া
৬.গর্ভধারণে দেরি হওয়া
৭.ওজন বেড়ে যায়
৮.টাইপ ২ ডায়বেটিস হতে পারে
৯.হার্ট ডিজিজ হতে পারে
১০.ঘুমের ব্যাঘাত হওয়া
সবারই সব সমস্যা একসাথে হবে তা নয়, আবার বয়সের সাথে পরিবর্তনও হতে পারে।
পলিসিসটিক ওভারি মানে ওভারিতে অনেক সিস্ট তা নয় বরং সিস্টের মতো ডিমের ফলিকল যার মধ্যে ডিমগুলো থাকে কিন্তু নিসৃত হতে পারে না। যদি হরমোনের পরিমাণ কমানো/ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা হলে ওভারি স্বাভাবিক কাজ করতে পারে। পিসিওএস হলে মনে রাখতে হবে-
১.এটি কখনও নির্মূল হবে না। সারাজীবন এ অবস্থা থাকে।
২.চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকা যায়
৩.এটা হার্ট ডিজিজ ও টাইপ ২ ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)কেন হয়?
এখনও ভালো করে জানা যায়নি। তবে পারিবারিকভাবে জেনেটিক কারণ এবং জীবনযাপনের কৌশলের ওপর নির্ভর করে।
পিসিওএসে কী কী বিষয় জানা জরুরি
* ইনসুলিন গ্লুকোজ মেটাবলিজমের মাধ্যমে শরীরে শক্তি জোগায়
* ৭৫-৯৫% নারীর ইনসুলিন রেজিস্ট্যানস হয় অর্থাৎ ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না তাই শরীরে ইনসুলিন ও গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়।
* ওজন বেশি হলে এটা আরও বেশি হয়
* নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যেমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
* ইনসুলিন বেড়ে যাওয়ার জন্য পুরুষ হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায় ও উপসর্গগুলোও বেড়ে যায় এবং
* প্রি ডায়াবেটিস / ডায়াবেটিস হয়।
অতএব নিয়মিত ব্যায়াম,সুষম খাবার এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
রোগ নির্ণয় করা যায় কিনা?
১.উপসর্গের উপস্থিতি
২.অনিয়মিত মাসিক
৩.আলট্রাসাউন্ড করে রোগ নির্ণয় করা যায় – ২০ /ততোধিক ফলিকল এ তিনটির দুটি থাকলেই পিসিওএস বলা যায়। কিশোরীদের ক্ষেত্রে ১ এবং ২ থাকলেই পিসিওএস বলা যায়।
ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)সমাধানের উপায়-
১.উপসর্গগুলো প্রশমিত করা।
২.মানসিক সাস্থের উন্নতি
৩.দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করা
৪. সন্তান নিতে চাইলে সে বিষয়ে নজর দেয়া
৫.নিজের প্রতি যত্নশীল হয়া।
৬. যদি সমস্যা থাকে তা হলে সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
জীবনযাপনের কলাকৌশল
যদি সঠিক না থাকে তা পরিবর্তন করতে হবে।
খাবারের বিষয়ে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সুষম খাবার খেতে হবে,শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে যাতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শারীরিকভাবে কর্মক্ষম,সচল থাকার জন্য ব্যায়াম করতে হবে।
সেটা হতে পারে হাঁটা,সাইকেল চালনা,পছন্দের খেলা ইত্যাদি।
যে সমস্ত অভ্যাস স্বাস্থ্যসম্মত নয় তা বর্জন করতে হবে। যেমন- ধূমপান করা,পানীয় পান করা ।
খাদ্যাভ্যাস
সুসম খাবার পরিমাণমতো খেতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার কমাতে হবে। ওট, ব্রাউন রাইস, হোল গ্রেইন ব্রেড খাবার তালিকায় থাকলে ভালো।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে টোটাল ক্যালরি কমাতে হবে অথবা পুষ্টিবিদের সাহায্য নিতে হবে। ভাজা খাবারের চাইতে সিদ্ধ করা খাবার ভালো। শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে।
পরিমাণমতো প্রোটিন খেতে হবে; যাতে কম ফ্যাটের মাংস, মাছ,ডিম, কম ফ্যাটের দুগ্ধজাত খাবার, বাদাম এবং বেশি করে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
দইয়ে যেহেতু প্রোবায়োটিক থাকে তাই দই ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং অন্ত্রজীবাণু সুস্থ রাখে।
চিনিযুক্ত খাবার, শরবত,পানীয়,চকোলেট, ফাস্ট ফুডে ওজন বাড়ে তাই এগুলোকে বর্জন করতে হবে। ফল,শাকসবজি শরীরের প্রদাহ হওয়া থেকে রক্ষা করে তাই এগুলো পিসিওএস এস এর রোগীদের জন্য অনেক ভালো।
ব্যায়াম মানসিক প্রশান্তি দেয়, শক্তি বাড়ায়, সুগারের মাত্রা কমায়। ৫-১০% কমালে মাসিক নিয়মিত হয় এবং সন্তান ধারণের যোগ্যতা বাড়ায়।
নিয়মিত ব্যায়ামের জন্য গ্রুপ অথবা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়া ভালো।
পিসিওএসের জন্য স্বীকৃত গাইডলাইন (২০১৮ সাল)
১.যদি ওজন বাড়তে না দেয়ার প্রয়োজন হয় –
ক. ১৮-৬৩ বছর বয়সের মধ্যে ১৫০ মিনিট/সপ্তাহে মডারেট ইনটেনসিটিতে অথবা ৯০ মিনিট খুব দ্রুততার সাথে।
খ. বয়স ১৮ বছরের নিচে হলে ৬০ মিনিট / প্রতিদিন কমপক্ষে মডারেট অথবা জগিং করতে হবে।
গ. ১০ মিনিট করে / ১০০০ স্টেপ / ইপিসোড করে ৩০ মিনিট প্রতিদিন করে ব্যায়াম করতে পারলে ভালো।
২. যদি ওজন কমানোর প্রায়োজন হয়-
ক. ২৫০ মিনিট/ সপ্তাহ মডারেট ইনটেনসিটিতে অথবা ১৫০ মিনিট জগিং/ সপ্তাহে অথবা দুটো মিলিয়ে
খ. মাংসপেশি শক্তিশালী করার ব্যায়াম
গ. ৩০ মিনিট/দিন। ৯০ মিনিট/ সপ্তাহে এরোবিক মডারেট অথবা জগিং শরীরের জন্য অত্যন্ত ভালো। নিজের বিএমআই দেখুন, ওজন মাপুন এবং পরিকল্পনা করে ধীরে ধীরে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে সুস্থ থাকুন।
পিসিওএস ঘুমের সমস্যা করে। সেজন্য স্বাস্থ্যসম্মত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ঘুমের ব্যাঘাত হলেই ওজন বাড়তে পারে।
মানসিক চাপ কমাতে হবে। পিসিওএস সম্পর্কে জানতে হবে, সাপোর্ট নিতে হবে ও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। পরিবার, বন্ধু, সাপোর্ট গ্রুপের সহযোগিতায় এবং কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
দাম্পত্যের সমস্যা…
পিসিওএস সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। বাচ্চা ধারণে বিলম্ব, মেজাজ, ডিপ্রেশন, সেক্সে অনীহা, আপনজনের অবহেলা ও কটূবাক্য সম্পর্কের অবনতির প্রধান কারণ।
সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, কাউন্সিলিং ও চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
মাসিকের সমস্যা-
পিসিওএসে নিয়মিত নাও হতে পারে। বছরে ৪ বারের কম হলে চিকিৎসা নিতে হবে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি খেতে পারবেন মাসিক নিয়মিত চাইলে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আরও কিছু ওষুধ খাওয়া যায় যেমন- মেটফরমিন।
ত্বকের সমস্যা-
শরীরে অবাঞ্ছিত লোম ও মুখে ব্রন বের হতে পারে।
সুস্থ জীবনের পদ্ধতি নিলেই অনেক সময় সমাধান হয়ে যায়।
এছাড়া কসমেটিক্স কেয়ার নেয়া যায় যেমন- ক্রিম ব্যবহার ও লেজার দিয়ে চিকিৎসা।
কিছু ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে পারেন। গর্ভধারণের সমস্যা-
৬০-৭০% গর্ভধারণে সমস্যা হয় না।
৩৫ বছর বয়সের পর সম্ভাবনা কমে যায়।
ডিম তৈরি হয় না অথবা কম হয়; এরকম হলে চিকিৎসা নিতে হবে। অতএব এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পিসিওএসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব-
১.হার্ট ডিজিজ
২.ডায়াবেটিস টাইপ ২
৩.গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস
৪. জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
পিসিওএস নিয়ে সচেতন হোন, সুস্থ জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলুন, সচল থাকুন ও প্রয়োজনে চিকিৎসা নিন, দেখবেন ভালো থাকবেন।

